বৃটিশ শাসনের অবসানের পর থেকেই এ ভূখন্ডে আলেম সমাজের নেতৃত্বে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। সে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তখনকার গণ পরিষদ ১৯৫০ সালে আলেম সমাজের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে যে, “আলেমরা একমত হয়ে শাসনতন্ত্রের কোন ভালো প্রস্তাব দিতে পারবে না”। তখনকার সাহসী আলেম সমাজ গণপরিষদের সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেন। মুসলিম উম্মাহর এমন সন্ধিক্ষণে তখনকার আলেম সমাজ নিজেদের মধ্যকার সব মতপার্থক্য ও ভেদাভেদ ভূলে এক ঐতিহাসিক সর্বদলীয় উলামা সম্মেলনে মিলিত হন।
১৯৫১ সালের ২১ শে জানুয়ারী সেই সর্বদলীয় উলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় করাচীতে। এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী রাহিমাহুল্লাহ। তদানিন্তন পাকিস্তানের ৩১ জন শীর্ষ আলেম সে সম্মেলনে যোগদান করেন। সেই ৩১ জন শ্রেষ্ঠ উলামার মধ্যে মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহ বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী হিসেবে যোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এসময়ে হানাফি,আহলে হাদিস, সহ সব ফিরকার শীর্ষ আলেমগনের ঐতিহাসিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল।
সেই সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে শাসনতন্ত্রের জন্য ২২ দফা প্রস্তাবের মূলনীতি গৃহীত হয়েছিলো। যা ইতিহাসে “২২ দফা ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রস্তাব ” নামে খ্যাত হয়ে আছে। অবশেষে সকল মত ও পথের উলামায়ে কেরাম এক হয়ে সেই ২২ দফা দাবী সরকারের কাছে উত্থাপন করেন। এ ছাড়া সে সময়ে এই ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রস্তাবের পক্ষে গণস্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করা হয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে কিছু ইসলামী বৈশিষ্ট অন্তর্ভুক্ত হয়। যা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। সংক্ষেপে তার কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
★ দেশের নামের আগে “ইসলামি প্রজাতন্ত্র” সংযোজন।
★ শাসনতন্ত্রের প্রারম্ভে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” লেখা হয়।
★ শাসনতন্ত্রের ভুমিকায় “সমগ্র বিশ্বের উপর একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ” – এ কথা স্বীকার করা হয়।
★ জনগনকে একটি পবিত্র আমানত মনে করে আল্লাহ প্রদত্ত সীমার মধ্যে ক্ষমতা পরিচালনা করতে হবে- একথা স্বীকার করা হয়।
★ ” ইসলামের সামাজিক সুবিচারের উপর ভিত্তি করে একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র” – একথা স্বীকার করা হয়।
★ ইসলামের নীতি অনুসরণ করে গনতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য ও সামাজিক সুবিচারের মূলনীতি প্রয়োগ করা হবে।
★ বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে স্বাধীন করা হবে। ইত্যাদি।
১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের এই শাসনতন্ত্র রচিত হয় এবং ২৩শে মার্চ তা কার্যকর হয়।
কিন্তু দুঃখজনক যে মাত্র আড়াই বছর পর ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা এই শাসনতন্ত্র বাতিল করে সামরিক আইন জারি করেন।
এ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, দেশ জাতি ও ইসলামের জন্য মুসলিম উম্মাহর নেতৃবৃন্দের উদার ঐক্যচিন্তা আজও আমাদের ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে।
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের উলামায়ে কিরাম এইসব গৌরবোজ্জ্বল ঐক্যের সংগ্রামী ইতিহাসের উত্তরাধিকার। ঐক্যের এ ইতিহাসকে ভিত্তি করে যুগে যুগে উম্মাহর ক্রান্তিকালে তারাও ভেদাভেদ ভুলে বাতিলের বুক কাঁপানো ইস্পাত কঠিন ঐক্যের নজির স্থাপনে বারবার এগিয়ে এসেছেন।
তাই হতাশার মেঘ কেটে আশার আলো জ্বালাবার বোধ হয় এখনই সময়! মজলুম মানবতার রাহবার হিসাবে উলামায়ে হযরত ও ইসলামী নেতৃত্বের দিকে আজ দেশ ও জাতি চাতক পাখির মত তাকিয়ে আছে।
পারস্পরিক সম্প্রীতির বদলে অনৈক্য, বিভেদ ও নেতিবাচক চর্চায় আল্লাহর গোলামদের হৃদয়ে আর কত রক্তক্ষরণ হতে থাকবে ?
সব ভেদাভেদ ও সংকীর্ণতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাই ইসলামী ঐক্যের এমন উদার চিন্তায় যারা নতুনের কেতন উড়াবেন, তাদেরই বিজয় মুকুট পরাতে মজলুম মানবতা যেন আজ উন্মুখ হয়ে আছে।
ইতিহাসের একটা নতুন বাক যেন সমাগত।