আজ শহীদ কামারুজ্জামান ভাইয়ের ৫ম শাহাদাত বার্ষিকী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের এক স্বর্ণালি সম্পদ। যা দীপ্তি ছড়াবে যুগ যুগান্তর ধরে। মেধা, প্রতিভা, দুরদর্শিতা, বুদ্ধিবৃত্তি, উদ্ভাবনী শক্তি, প্রজ্ঞা, বিশ্লেষণী শক্তি, আন্তর্জাতিকতা, প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্র নেতৃত্ব, সময়ের সাহসী সাংবাদিকতা, বহু গ্রন্থের লেখক, গনমুখী রাজনৈতিক নেতৃত্বের এক অসাধারন সমন্বয়ের নাম শহীদ কামারুজ্জামান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর শহীদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন।
একজন প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রনেতা হিসেবে তার সুদক্ষ ও সাহসী নেতৃত্বে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ছাত্রশিবির একটি উদীয়মান ও জনপ্রিয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে আবির্ভুত হয়।
তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতেও একজন শীর্ষ নেতা ছিলেন। কেন্দ্রীয় বৈঠকগুলোতে তার যুক্তি ও তথ্যপূর্ণ বক্তব্য আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম।
৯০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, চারদলীয় জোট গঠন ও আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দানে তার অসামান্য অবদান সর্বজন বিদিত। বৈদেশিক ও কুটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক মহলে সু-পরিচিত ও গ্রহনযোগ্য করার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ও অবদান অবিস্মরনীয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর, আন্তর্জাতিক সভা সম্মেলন ও সেমিনারে অংশগ্রহণ ও প্রবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে তিনি বাংলাদেশে ইসলামের উজ্জল সম্ভাবনাকে তুলে ধরেন। তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এ জাতির তরুণ সমাজকে বিপুলভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।
এসব অনন্য ও অসাধারন যোগ্যতার অধিকারী শহীদ কামারুজ্জামানের শাহাদাত এদেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে যে শূণ্যতার সৃষ্টি করেছে তা পূরণ হবার নয়। আমরা কি সম্পদই না হারিয়েছি! আমরা তা তার রেখে যাওয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি।
স্মৃতি কাতরতা একটি আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীদের জন্য কখনো কখনো স্ফুলিংগের গতি দেয়। প্রেরণার অফুরন্ত উৎস হয়ে সামনে চলার অপ্রতিরোধ্য শক্তি যোগায়। প্রিয় নেতা কামারুজ্জামান ভাই আমার জীবনে সেই স্ফুলিংগ ও শক্তির আঁধার। কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে আমার প্রায় তিন যুগের স্মৃতি। সে স্মৃতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার। শ্রদ্ধা, আস্হা, সস্ভাবনা ও স্বপ্নের। তার অনেক কিছুই আমাকে শিহরিত করে। তার স্মৃতি আমার জীবনের প্রথম দিনগুলোর প্রাণোচ্ছল উদ্দীপনায় আজও আমাকে উজ্জীবিত করে। আবার বেদনায় হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে কখনো কখনো।
তিনি যখন শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়ে প্রথম খুলনায় আসলেন তখন আমার বয়স বিশ-এর কোঠায়। এক প্রখর রৌদ্রতপ্ত দুপুরে খুলনা বিমান অফিসে কামারুজ্জামান ভাই ঢাকা থেকে আসবেন। তাই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বি এল কলেজ থেকে ছুটে গিয়েছিলাম। আমি তখন অনার্সের ছাত্র এবং শিবিরের সাথী। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি কামারুজ্জামান ভাইকে নিয়ে আমরা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে রাজপথ মুখরিত করে খুলনা সিটি কলেজের ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম। তিনি সিটি কলেজের চত্বরে এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে ছাত্র সমাজের জন্য উজ্জীবনী এক বক্তব্য পেশ করলেন।
২০০০ সালে তৎকালীন আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমের (রহঃ) সফরসঙ্গী হয়ে আমি এবং কামারুজ্জামান ভাই কক্সবাজারে যাই। প্রায় চার দিনের এই সাংগঠনিক সফরে কামারুজ্জামান ভাইয়ের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অনেক গল্প অনেক কাহিনী অনেক শিক্ষা জানার সুযোগ পেয়েছি। সম্পর্কের এতটা গভীরে তিনি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন যে, তিনি আমার খুলনার গ্রামের বাড়িতে ও ঢাকার এমপি হোস্টেলে ভাবি সহ আসতেন। এ সময়ে বহু সাংগঠনিক উপদেশ ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করতেন।
একবার খুলনায় আমার বাড়িতে আসার পথে রেলক্রসিংয়ে আমাদের বহনকারী গাড়ি এবং ট্রেন মুখোমুখি হয়ে যায়। অলৌকিক ভাবে আল্লাহ সেদিন আমাদের সকলের জীবন রক্ষা করেন। আমরা যখন উৎকণ্ঠিত তখন কামারুজ্জামান ভাই আমাদের সকলকে জীবনের সাদাকাহ দিতে বললেন এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। সেদিন আল্লাহর উপর তাঁর তাওয়াক্কুল ও দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ হলাম।
কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে জীবনের শেষ দেখা আমার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৬ নাম্বার ডিভিশন সেলে পাশাপাশি কক্ষে আমরা থাকতাম। কারা কক্ষে তিনি প্রায় সারাক্ষণই সালাত, তেলাওয়াত, তাসবিহ তে মশগুল থাকতেন। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে তখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে তথাকথিত শাহবাগীদের আওয়াজ এবং চিৎকার শোনা যেত। এসব নিয়ে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে যখন কথা বলতাম তখন তিনি বলতেন, “পরওয়ার এতে আমি বিচলিত নই”।
তিনি কোরআনের আয়াত শুনিয়ে তার ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতেন। আমাকে খুলনার মামলায় হাজিরা দিতে ঢাকা-খুলনা কারাগারে আনা নেয়া করা হতো। একবার খুলনা থেকে ফিরে গিয়ে দেখি আমার বিছানার চাদরটা নেই। কামারুজ্জামান ভাই আমাকে ডেকে বললেন “পরওয়ার তোমার চাদরটা আমি আমার বিছানায় বিছিয়েছি, কালি পড়ে তোমার বিছানার চাদরটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তুমি মনে কিছু নিও না।” আমি বললাম “কামরুজ্জামান ভাই, কি বলেন আপনি! এটাতো আরও আমার সৌভাগ্য, এটা আপনার কাছেই থাকুক।”
এসব স্মৃতি শুধু আজ বেদনার।
কামরুজ্জামান ভাই যখন প্রশান্ত চিত্তে ফাঁসির মঞ্চে যান তখনও আমি খুলনা কারাগারে বন্দি। কারাগারে তার শাহাদাতের খবর শুনে আমি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ি এবং তার শাহাদাত কবুলের জন্য আল্লাহর দরবারে আহাজারি করতে থাকি।
শাহাদাতের পূর্বে তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন,
“আমি যে আদর্শের আন্দোলন করি, আমাকে মেরে ফেললেও সে আদর্শ এই দেশে যুগ যুগ ধরে লালিত হবে। ইনশাআল্লাহ একদিন এদেশের মাটিতে ইসলাম বিজয়ী হবে।”
আমরা শহীদ কামারুজ্জামানের রেখে যাওয়া সেই আদর্শের অগ্নি মশাল নিয়ে এগিয়ে চলেছি। আমাদের সেই চলা দুর্বার, অপ্রতিরোধ্য ও মৃত্যুভয়হীন চেতনায় দীপ্ত।
আল্লাহ গাফুরুর রহীম ! প্রিয় কামারুজ্জামান ভাইয়ের শাহাদাত তুমি মঞ্জুর করো। আমীন।