আমাদের পূর্বসুরী সকল সিলসিলা ও ফিরকার সম্মানিত ওলামায়ে দ্বীনের মধ্যে যে পারস্পরিক মহব্বত শ্রদ্ধাবোধ সহানুভূতি ও শিষ্টাচার বিদ্যমান ছিল তা আজও আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। সেটা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রেরণার উৎস এবং সূত্র হতে পারে।
বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য এবং ভিন্নমত সহকারে তারা উম্মাহ ও দ্বীনের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যমত গড়ে তুলতে পারতেন। একসাথে বসতেন। একসাথে চলতেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও আজ এটা সত্য যে, বর্তমানে এমন পরিবেশ না দেখে মুখলিস আলেমে দ্বীন ও ঐক্য পিপাসু ইসলামী জনতার হৃদয় ব্যাথিত।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, ভাষা সৈনিক, সাবেক ডাকসু জি এস, মজলুম জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম (রহঃ) তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শতভাগ আন্তরিকতা, উদারতা ও দরদ দিয়ে দেশের সকল শীর্ষ আলেম ও পীর মাশায়েখদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে গেছেন। সবার ঐক্যের চেষ্টায় অনেক অবদান রেখে গেছেন।
তিনি সবার সোহবতে যেতেন, আবার সবাই তার সোহবতেও আসতেন। তাঁদের অনেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আজও সে সব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন।
অধ্যাপক গোলাম আযম রচিত ‘ইকামাতে দ্বীন’বইতে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যের জন্য তাঁর গভীর আবেগ ও অভিব্যাক্তি এভাবে প্রকাশ করেছেন –
“আমার পিতা থেকে ইসলামকে একটি ধর্ম বলেই বুঝেছিলাম। হযরত মাওলানা থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির লেখা থেকে ও মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর সোহবতে বুঝতে পারলাম যে, ইসলাম অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ধর্ম। তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে অনুভব করলাম যে, ইসলাম এক মহান মিশন এবং এর জন্য জীবন উৎসর্গ করাই ঈমানের দাবি।
এদেশে তাবলীগ জামায়াতের আমীর হযরত মাওলানা আব্দুল আজিজ (রহঃ) এর সাথে চিল্লা দেবার সুযোগ পাওয়ায় এবং তাবলীগের চিল্লা উপলক্ষে হিন্দুস্তান গিয়ে অনেক যোগ্য আলেম হতে দ্বীনের পথে জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণা পাই। সাড়ে চার বছর তাবলীগ জামায়াতের নিয়মিত কাজ করার যে তৌফিক আল্লাহ পাক দিয়েছেন তাতে আমার জীবনে এ জযবা পয়দা হয়েছে যে, ইসলামই মুসলিম জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
জামায়াতে ইসলামীতে এসে অনুধাবন করলাম যে, ইসলাম এমন এক বিপ্লবী আন্দোলন, যার মাধ্যমে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানকে কায়েম করার জন্য চেষ্টা করা মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় ফরজ।
এখন আমি কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি যে, হযরত থানভী (রহ), তাবলীগ জামায়াত, তমুদ্দুন মজলিস ও জামায়াতে ইসলামী আমাকে ক্রমিক পর্যায়ে সত্যিকারের মুসলিম হবার প্রেরণা দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীতে এসে পূর্ণাঙ্গ ইসলামের রূপ বিস্তারিতভাবে জানবার সুযোগ পেয়েছি।
জামায়াতে ইসলামীর বাইরে এমন কয়েকজন বড় আলেমের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল, যাদের কাছ থেকে দ্বীনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমি যথেষ্ট আলো পেয়েছি। তাঁরা যেহেতু আমাকে স্নেহ করতেন সেহেতু অল্প সময়ে অনেক বেশি ফায়দা তাদের কাছ থেকে হাসিল করার সুযোগ তাঁরা দিতেন।
হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহ এর মাধ্যমেই হযরত মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী রহমাতুল্লাহি আলাইহির মত বড় আলেমের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
সকল প্রকার দ্বীনি খিদমত ও সব দ্বীনি সংগঠনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সবার সম্পর্কে উদার মনোভাব পোষণ করার ব্যাপারে এ দু’জনের মতো এমন বিশালমনা লোক বাংলাদেশে আমি পাইনি। “
মাওলানা মওদূদী (রহ.) এর লেখা বই নিয়ে বিতর্ক সম্পর্কে অধ্যাপক গোলাম আযম একই বইতে বলেন-
“কিছু সংখ্যক ব্যক্তি তাঁর বিভিন্ন লেখা থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে এমন বিকৃত ব্যাখ্যা করেছেন যে, কোনো নিরপেক্ষ পাঠক মূল বই ও সমালোচকদের লেখা পড়লে স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, লেখকের মূল বক্তব্যের সাথে সমালোচনার কোন মিল নেই। কতক সমালোচকের ভাষা থেকে তাদের বিদ্বেষই প্রকাশ পায়।
যারা অন্ধ বিরোধী ও বিদ্বেষী তারা সংশোধনের উপযোগী ভাষা ব্যবহার না করে ফতোয়ার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। এমনকি কারো কারো বক্তব্য হীন গালিগালাজের পর্যায়েও পড়ে। যারা সত্য তালাশ করেন তারা যদি মূল বই পড়ার চেষ্টা করেন তাহলেই শুধু সুবিচার করতে পারবেন। মূল বই যারা পড়েননি তারা কোনো সমালোচকের লেখা পড়েই যদি সিদ্ধান্ত নেন তাহলে অবশ্যই লেখকের প্রতি অবিচার করা হবে। আসামীর জবানবন্দি না নিয়ে শুধু ফরিয়াদির নালিশ শুনেই যে বিচারক রায় দিয়ে বসে তাকে কখনো ন্যায় বিচারক বলা চলে না।”
অধ্যাপক গোলাম আযম আরও বলেন-
“মাওলানা মওদুদীর লেখা বইয়ের মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের খেলাফ যদি কোন কথা থাকে তাহলে সেসব চিহ্নিত করার ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমরা নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে বিশ্বাস করি। তাই এদিক দিয়ে তার বইয়ের মধ্যে ভুল থাকলে তা আমরা কোনক্রমেই গ্রহণ করব না।
এ বিষয়ে একটি কথার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কেউ কেউ মাওলানা মওদুদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কোন কথা মূল বইয়ের বক্তব্য থেকে আলাদা করে (সিয়াক ও সাবাক অর্থাৎ পূর্বাপর সম্পর্ক ছাড়া) এমনভাবে পেশ করে থাকেন যার ফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় । তাই মূল বই না দেখে শুধু বিচ্ছিন্ন কোন কথার ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে পৌছা নিরাপদ নয় “।
(এ সব কথা লেখক তার ‘ইকামাতে দ্বীন ‘ বইতে ১৯৮১ সালে লিখেছেন)
মাওলানা মওদূদী (রহ) এর সাথে শীর্ষ আলেমদের মহব্বত ও বৃহত্তর ঐক্য চিন্তার বড় দু’টো উদাহরন হলঃ
১। ১৯৫০ সালে ইসলামি শাসনতন্ত্রের দাবীতে তদানিন্তন পাকিস্তানের সর্বশ্রেনীর আলেমদের নিয়ে করাচীতে সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী ( রহ) এর সভাপতিত্বে এক সর্বদলীয় উলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মাওলানা মওদূদী (রহ) সহ সকল ফিরকার ৩১ জন বড় বড় আলেম যোগ দেন। সে সম্মেলনে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ২২ দফা মূলনীতি ঘোষনা করা হয়।
২। মাওলানা মওদূদী (রহ.) সাংগঠনিক সফরে প্রথম ঢাকা এসেছিলেন ১৯৫৬ সালে। মাওলানার প্রথম ঢাকা আগমন উপলক্ষে ঢাকা শহর জামায়াত সাধ্যমত যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে।
মাওলানাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য যে সকল গন্যমান্য ব্যক্তি বিমানবন্দরে
উপস্থিত হয়েছিলেন, তন্মধ্যেঃ
* প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা আকরাম খাঁ (রহঃ)।
* লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়ার প্রিন্সিপাল খাদেমুল ইসলাম জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মোঃ শামছুল হক ফরিদপুরী (রহঃ)।
* জমিয়তে আহলে হাদিসের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফি আল কোরাইশী (রহঃ)।
* বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা নূর মোহাম্মদ (রহঃ)।
* মাওলানা মুফতি দীন মোহাম্মদ খান (রহঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বিকেল তিনটায় পি আই এ বিমানযোগে তিনি ঢাকায় পৌছেন। তিনি বিমানের দরজায় আসা মাত্র মাওলানা মওদুদী জিন্দাবাদ, জামায়াতে ইসলামী জিন্দাবাদ ইত্যাদি শ্লোগানে বিমানবন্দর মুখরিত হয়ে ওঠে।
মাওলানার সফরসঙ্গী ছিলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া তুফাইল মুহাম্মদ।
বিমানবন্দর থেকে অভ্যর্থনাকারী ছাত্রজনতা মিছিল সহকারে মাওলানাকে বিমানবন্দর থেকে নবাবপুর রোডে পৌছে দেয়।
(সূত্রঃ জীবনে যা দেখলাম।- অধ্যাপক গোলাম আযম।
দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা নং ১৪৪।)
এ ছাড়াও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক( রহ) এবং মুফতী ফজলুল হক আমীনির (রহঃ) নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট গঠন এবং তৎকালীন চারদলীয় জোটে অন্তর্ভুক্তির ইতিহাসও নিকট অতীতের বৃহত্তর ঐক্যের উদাহরণ।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকল পূর্বসূরীদের ভালো উদাহরণগুলোকে উম্মাহর ঐক্য চিন্তায় আরও উদার ও সহিষ্ণুতার সাথে গ্রহণ করবার তাওফিক দান করুন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামী দল ও শক্তিসমূহের ঐক্য খুবই প্রয়োজন। ইসলামী জনতার এখন এটাই প্রাণের আকুতি।
সকল ভেদাভেদ ভূলে এ ঐক্য প্রক্রিয়ার জন্য দায়িত্বশীল আলেম সমাজকেই অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে। মহান আল্লাহ সে তাওফিক দান করুন। আমীন।।