আমার ছাত্র জীবনের ঘনিষ্ঠ দ্বীনি সাথী নাছের ভাই। বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা ইউনিয়নের বর্ণি গ্রামের ছায়া সুনিবীড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে জন্ম গ্রহন করে মাটি ও মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। সেই বেড়ে ওঠা ছিল যেমন বহুমূখী প্রতিভাদীপ্ত, তেমনি সংগ্রাম মূখর।
আশির দশকে আমি বি এল কলেজে অনার্সের ছাত্র। ক্যাম্পাসে মিছিলে মিছিলে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুষ্টিবদ্ধ বাহু উঁচিয়ে আমরা যখন শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর, তখনই সেই মিছিলের বিপ্লবী সাথী আমার প্রিয় নাছের ভাই। সদা হাস্যোজ্জল নূরানী দীপ্তি ছড়ানো মুখ তার। সেই মিছিলে নাছের ভাইও বজ্রকন্ঠ।
আমার গ্রাম শিরোমনিতে বাড়ীর পাশেই এক আত্মীয়ের বাড়ীতে থাকতেন। লেখাপড়া আর সংগঠন দুটোই ছিল তার নেশা। সুবহে সাদিকে তার মধুর আজানের ধ্বনিতে আমরা মুগ্ধ হতাম। অল্প দিনেই তার প্রচুর ভক্ত তৈরী হলো। বন্ধু থেকে নেতা হয়ে উঠলেন। কর্মী তৈরীতে সিদ্ধহস্ত নাছের ভাই। আমার যেন প্রানের বন্ধুতে পরিণত হলেন। কারাবরন, শারীরিক নির্যাতন, মামলা-হামলা, ষড়যন্ত্র কোনো কিছুই দমাতে পারেনি নাছের ভাইকে। পর্যায়ক্রমে নিজ এলাকার ইউ পি চেয়ারম্যান, উপজেলা আমীর, জেলা শূরা সদস্য।
কতদিন তার সাথে গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছি লঞ্চে চড়ে। অনেক সাংগঠনিক কাজ,সফরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দু’জনের।
একবার শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহঃ) এবং আমাকে তার গ্রামের মাহফিলে অতিথি করে লঞ্চ রিজার্ভ করে নিয়ে গেলেন। ছাত্র জীবনে শায়খুল হাদীস এবং আমার এক মঞ্চে বক্তৃতার সে এক ভিন্ন অনুভব!
ঢাকা আলিয়ার ছাত্র গৌরম্ভার মাওলানা (মরহুম) শহিদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সমাবেশে ছাত্র সংঘর্ষে মারাত্নক আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ১০ দিন অজ্ঞান থাকার পর প্রায় একমাস চিকিৎসা শেষে যেদিন গৌরম্ভার বাড়ীতে এসেছিলেন, সেদিন তদানিন্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম খান মিলন ভাই,শহীদ শেখ বেলাল ভাই সহ নেতা কর্মীদেরকে নিয়ে এক বড় লঞ্চ রিজার্ভ করে নদী পথে গ্রামের কর্দমাক্ত দীর্ঘ রাস্তা মাড়িয়ে, গভীর রাতে হ্যজাক লাইটের আলোতে বর্নি ছায়রাবাদ স্কুল মাঠের সে বিরাট সংবর্ধনার রাতভর আয়োজনে প্রিয় নাছের ভাইয়ের সে কি অসাধারন কর্মবীরের মত সফল স্মরনীয় নেতৃত্ব!
অন্তত ৪৫ বছরের আবেগময় সে সব স্মৃতির নিবীড় বন্ধন। মুখলিস বন্ধু, সাধারন মানুষের কাছে তিনি বিপুল জনপ্রিয় খাদেম। অসংখ্য দুর্লভ বই-কিতাবের সংগ্রহ ছিল তার!
গতরাত তিনটার পর জেলা আমীরের ম্যাসেজ পেলাম নাছের ভাই অসুস্হ। ফজরের পর কেবল খোঁজ নিচ্ছি। ইসলামী ব্যংক হাসপাতাল, তারপর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সকাল পৌনে দশটায় জেলা আমীর কেঁদে উঠে বললেন নাছের ভাই চলে গেলেন। দুপুরে জানাযার পূর্বে ফোনে নাছের ভাইয়ের স্ত্রী মমতাজ ভাবীকে আমীরে জামায়াতের সালাম,দোয়া ও সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। ভাবী কেঁদে কেঁদে কঠিন পরীক্ষায় ধৈর্য্যের জন্য দোয়া চাইলেন। আমাকে বললেন, “আপনাকে যে উনি কতটা ভালোবাসতেন ! সবসময় আপনার কথা বলতেন, দ্বীনের জন্য ভালোবাসা আখিরাত পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়” বলে কাঁদলেন ভাবী।আমি এ অবস্হায় তাঁকে প্রিয়নবীর নসিহত স্মরন করিয়ে দোয়া করে শেষ করলাম।
ইসলামী বিপ্লবের আজীবন স্বপ্নে অন্তঃপ্রাণ প্রিয় নাছের ভাই। আপনি আমাদের রেখে আগেই মা’বুদের কাছে মর্যাদার সাথে পৌঁছে গেলেন!
প্রিয় নাছের ভাই!
কত মানুষকে যে আপনি আল্লাহর পথে ডেকেছেন! এ কাজে কত পথ প্রান্তর আপনার পায়ে ধূলা মলিন হয়েছে! আপনার আবেগ মোথিত দারাজ কন্ঠের গানে গানে কত চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পথের দিশা পেয়েছে! সুমধুর তিলাওয়াতের মূর্ছনায় আপনি কত হৃদয়কে বিগলিত করেছেন!
এ সবই রহমানুর রহীম কবুল করে আপনার নেক আমল দ্বারা গোনাহ সমূহ বদলিয়ে দিন। আপনার বড় সম্পদ নেক পিতা-মাতার দোয়ায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিতে আপনি সিক্ত হোন।
আপনি না কতবার শাহাদাতের তামান্না পেশ করেছেন?
প্রিয় নবীর (সা) ভাষ্য অনুযায়ী সেই সত্য তামান্না আপনাকে শাহাদাতের মর্যাদায় পৌঁছে দিক।
দয়াময় মাবুদের দরবারে এই আমার ব্যাথিত প্রাণের আকুতিভরা মুনাজাত।
আয় আল্লাহগো!
জান্নাতেও তুমি আমাদেরকে সাথী করে দিও।
আমীন! ইয়া রাব্বুল আলামীন!