আপিল খারিজের পর থেকেই প্রতি মুহূর্ত উৎকন্ঠায়। কখন না জানি ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনি। কারাগারে বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল তো নেই। সরকারী খবরই শুনতে হয়। লক-আপের কারণে ২২ নভেম্বর রাতে আমরা কেউই খবর জানতে পারিনি।
কারাবন্দী সাবেক মন্ত্রী ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাহেবের কক্ষে টিভি থাকায় উনি সব খবরগুলো রাতে জানতে পেরেছেন। ২৩ নভেম্বর সোমবার অতি ভোরে ফজরের সালাতের জন্য কাশিমপুর কারাগারের ডিভিশন সেলের নামাজ কক্ষের সামনে কেবল পৌছেছি। ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাহেব পেরেশান হয়ে আমার কাছে এসে অশ্রুসিক্ত হয়ে কেঁদে উঠে বললেন, ” সব যন্ত্রনা শেষ হয়ে গেছে। রাতেই দুজনকে (আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী) ফাঁসি দিয়েছে। আর তাদের যন্ত্রনা ভোগ করতে হবেনা ” । দুঃখে ব্যাথায় উনি যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন কারাবন্দী সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার, সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ভাই একে একে এসে পড়লেন।
ডঃ মোশাররফ সাহেব গতরাত থেকে টেলিভিশনের খবর, ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদি নিয়ে সরকারের নাটকীয়তার কথা বলে চলছিলেন। দু’দিন থেকেই এমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছিলাম আমরা। আজ আমরা সবাই বেদনা ভারাক্রান্ত, অশ্রুসিক্ত।
কদিন আগেই আমি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের সাথে তার কক্ষে দেখা করে এলাম। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের পাশের কক্ষেই তিনি থাকতেন। আল্লামা সাঈদী সাহেবের সাথেও ওই সময় কুশল বিনিময় এবং আবেগময় অনেক কথাবার্তা হলো।
ক’দিন পূর্বেই কারা কর্তৃপক্ষ এখান থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করেছে। আর প্রিয় মুজাহিদ ভাই তো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই ছিলেন।
নিজেদের কষ্ট চেপে রেখে আমরা জামায়াতের সাথে ফজরের সালাত আদায় করলাম। সালাত শেষে আমরা বিশেষভাবে দু’জনের জন্য দোয়া করলাম।
দিনটা খুব বেদনাহত হয়ে কাটালাম। পত্রিকা পড়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। মুমিনের শাহাদাতের আকঙ্খার সাথে আল্লাহর ইচ্ছার মিল হয়েছে বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম।
শাহাদাতের ক’দিন পর পত্রিকায় মুজাহিদ ভাইয়ের ছোট ছেলে আলী আহমাদ মাবরুরের লেখাটা পড়লাম। লেখায় মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে তাঁর পরিবারের শেষ সাক্ষাতের আবেগময় বর্ণনা। চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। যেমন শহীদ তেমন পরিবার। আলহামদুলিল্লাহ।
ইসলামী আন্দোলনে এ ত্যাগের কত শক্তি! কত প্রেরণা! তা হৃদয়কে নাড়া দিয়ে উঠলো। দৃঢ় প্রত্যয় জেগে উঠলো। এ ত্যাগ বৃথা যাবেনা-ইনশাআল্লাহ।
ক’দিন পর কারাগারে সাক্ষাতে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- মাবরুরের লেখাটা পড়েছো কিনা? সে জানালো, “ছেলে-মেয়েরাসহ আমরা সবাই পড়েছি। এছাড়া মুজাহিদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে তাঁর পরিবারের সাথে সাক্ষাত করে দোয়া ও সহানুভূতি জানিয়ে এসেছি। “
স্ত্রীর একথা শুনে আমি শুকরিয়া আদায় করলাম।
বিগত ঈদুল ফিতরের একদিন পর ২০ জুলাই আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুজাহিদ ভাইও একই কারাগারে ফাঁসির সেলে। আমার ছোট বোন জেসমিন নাহার জেবু ঈদ উপলক্ষে ভালো খাবার পাঠালো। মুজাহিদ ভাইয়ের পছন্দ মতো মিষ্টি, পিঠা, ভর্তা, গোশত ইত্যাদি কয়েক রকম খাবার ফাঁসির সেলে পাঠালাম সেবকের মাধ্যমে। এর কয়েকদিন পর আমার বড় মেয়ে নাদিয়া সিদ্দীকা কারাগারে মুজাহিদ ভাইয়ের জন্য তার পছন্দের মিষ্টি পাঠালো। তিনি খেয়ে খুবই খুশী হয়েছিলেন।
তিনি এখন শাহাদাতের সৌভাগ্য নিয়ে মাবুদের সান্নিধ্যে। আমি কাশিমপুর কারাগারে আজ বন্দী। সেসব স্মৃতি আর তাঁর প্রীতিপূর্ণ মহব্বতের ছবিগুলো যেন বারবার হৃদয় পটে ভেসে উঠছে আর আমাকে ব্যাথাতুর করে তুলছে।
মনে পড়ছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম যেদিন মুজাহিদ ভাই আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে মহব্বতে সিক্ত করেছিলেন সেদিনের স্মৃতি। পাশাপাশি কক্ষে ছিলাম ক’দিন।
আজ সকালে শাহাদাতের খবর পেয়ে কাশিমপুর কারাগারে দ্বীনি ভাইদের চোখে-মুখে বেদনার মলিনতা। কষ্টের বিষন্নতা। দোয়া আর চোখের পানি।
ইয়া রাব্বুল আলামীন! তুমি আমার প্রিয় নেতা, তোমার নিবেদিতপ্রাণ গোলাম, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের শাহাদাত মঞ্জুর করে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকাম দান কর।
( ২০১৫ সালের ২২ শে নভেম্বর প্রিয় নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের শাহাদাতের পর লেখা আমার কারাগারের ডাইরী থেকে)