আজ ৩ জুন অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থ বছরের জন্য ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ঋণ নির্ভর বাজেট পেশ করেছেন সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ৩ জুন ২০২১ প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন:
“অর্থমন্ত্রী জনাব আ.হ.ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঋণ নির্ভর ঘাটতি বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। বলা হয়েছে এটি হবে জীবন ও জীবিকার বাজেট এবং সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তা সম্প্রসারণ। অর্থমন্ত্রীর এ চমকপ্রদ কাগুজে বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ, আর বাজেট ঘাটতি হচ্ছে জিডিপির ৬.২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৩ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেট এবং প্রবৃদ্ধির হার বাস্তবতা বিবর্জিত ও কল্পনা নির্ভর। বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। চলতি বাজেটের অধিকাংশই সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট এডিপি ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্ব ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের। এটি অর্জন সম্ভব নয় জেনে পরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু গত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকেও সংগ্রহ ১ লাখ ৩ হাজার ৪১৭ কোটি কম, যা আদায় করার কথা মে ও জুন এ দুই মাসে। যা কখনো সম্ভব নয়।
বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ব্যাংক ঋণ ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেটের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ঋণ নির্ভর। এই ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই সরকারের নাভিশ্বাস উঠে যাবে।
এ বাজেটের মাধ্যমে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা পূর্বের ন্যায় আরো বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত বছর ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার কথা ছিল তা নিতে পারেনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছে। এ বছর বাজেটে ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে আরো সংকটের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। সরকারের প্রস্তাবিত এ বাজেটে দেশের আর্থিক শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। গত বছর জিডিবি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮.২। সেটা অর্জন করা সম্ভব না হওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন করে তা ৫.৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশার বাণী শোনালেও তা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত গোটা দেশ। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছে মানুষ। করোনায় আক্রান্ত রোগীরা এ হাসপাতাল থেকে সে হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার এ ভঙুর পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কেটি টাকা- যা বাজেটের ৭.৪ শতাংশ। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী নেই। মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ মোটেই যথেষ্ট নয়। আমরা মনে করি চলমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাজেটের ১০ শতাংশ হওয়া দরকার। চলতি অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা- যার ২৬ শতাংশ মাত্র স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়েছে। তাই শুধুমাত্র বাজেটে বরাদ্দ দিলেই হবে না তা বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
করোনা পরিস্থিতির অযুহাতে দীর্ঘ ১৪ মাস যাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শীক্ষার্থীগণ জ্ঞানের আলো ও শিক্ষা অর্জনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্রমেই দেশ মেধাহীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণামূলক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। অর্থমন্ত্রীর বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ১৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাব শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় গুরুত্ব দিলেও এক্ষেত্রে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা বা রূপরেখা তুলে ধরা হয়নি। বাজেটে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সহ সকলের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার গতানুগতিক বক্তব্য ছাড়া নতুন কোনো ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি।
কৃষিখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩১ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কৃষকরা বরাবরই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়না। প্রস্তাবিত বাজেটে উৎপাদনের উপকরণের মূল্য হ্রাসের কোনো কথা বলা হয়নি। রাসায়নিক সারের মূল্য কমানো, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত সহ কৃষিখাতকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি।
বাংলাদেশে শিল্প খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ সম্পৃক্ত। এ খাতকে প্রস্তাবিত বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
চলতি অর্থবছরে করোনার কথা চিন্তা করে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল রাখা হয়েছিল। আগামী অর্থবছরেও ১০ হাজার কোটি টাকার করোনা তহবিল থাকছে। এই তহবিলের টাকা কোথায় কিভাবে খরচ করা হবে সে ব্যাপারে বাজেটে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। করোনা ফান্ডের টাকা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এমনকি এই খাতের অর্থ আত্মসাতের কারণে অনেককে জেলেও যেতে হয়েছে। এছাড়া করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ নিয়ে দেশে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমরা মনে করি করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণে আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার।
করোনা ভাইরাসের কারণে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মহীন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছে। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে এসে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত এসকল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। বাজেট বক্তৃতায় দেশে বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকার বাঁধ ভেঙে কৃষিজমি, মাছের ঘের ভেসে যাওয়া এবং রাস্তা-ঘাট-ব্রীজ-কালভার্ট-বেড়ীবাঁধ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে কোনো বরাদ্দের কথা বাজেটে বলা হয়নি।
করমুক্ত আয়ের সীমা পূর্বের ন্যায় ৩ লক্ষ টাকা রাখা হয়েছে। প্রায় সকল খাতেই আয় ও ব্যয়ের অংক বাড়ানো হলেও, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। আমরা মনে করি করোনা ভাইরাসের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়ের সীমা অন্তত: ৪ লক্ষ টাকা হওয়া উচিত।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। মূলত দলীয় এবং দলীয় পছন্দের লোকদের কালো টাকার পাহাড়কে সাদা করার সুযোগ দেয়ার জন্য বাজেটে এ প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আমরা মনে করি যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে কর ফাঁকি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। অথচ আমরা লক্ষ্য করছি যাকাতের টাকার উপর কর আদায় করা হয়। আমরা যাকাতের টাকা করমুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দের কথা বলা হয়নি। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্য বীমার বিষয়ে বাজেটে ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে আমরা মনে করি।
সর্বোপরি করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকর সুশাসন, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং সকল স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”