আজ ঐতিহাসিক ১লা মে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামের প্রতীকী দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল অধিকার বঞ্চিত মানুষের লড়াইয়ে মে দিবস এক অনন্য প্রেরণা। আজকের এইদিনে বিশ্বের সকল শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মেহনতি মানুষের সকল ন্যায্য অধিকারের সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ও সহানুভূতি প্রকাশ করছি।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ১ লা মে এক অনন্য গৌরবময় দিন। আজ থেকে ১৩১ বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১ লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় মেহনতি মানুষের বহু ন্যায্য অধিকারের দাবী আজও দুনিয়ার দেশে দেশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত। আমেরিকার শিকাগো থেকে শুরু করে দেশে দেশে মেহনতি মানুষের অধিকারের জন্য আত্মদান যেন তাদের অধিকারের মূর্ত আর্তনাদ।
একথা কে না বিশ্বাস করবে যে, আধুনিক বিশ্বের শিল্প, অর্থনীতি ও সভ্যতার বিকাশের সাথে মিশে আছে শ্রমজীবী মানুষের রক্ত আর ঘাম। হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে গগনচুম্বী প্রাসাদ আর অট্টালিকার সারি। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে- মেহনতী মানুষের রক্ত পানি করা শ্রমশক্তির জোরে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব তথা সভ্যতার বিকাশের সূচনা পর্বে শ্রমিকদের অধিকার বলতে তেমন কিছুই ছিলনা। না ছিল তাদের ন্যায় সংগত মজুরী, না ছিল নির্ধারিত কোন কর্মঘণ্টার সীমানা। মানবেতর জীবের মত শ্রমক্ষেত্রে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হতো। প্রাচীন মিশরের শ্রমদাসদের চেয়েও তাদের অবস্থা খারাপ ছিল। শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও নির্যাতন যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় তখন শোষিত বঞ্চিত, নির্যাতিত শ্রমিক সমাজ তা রুখে দিতে বাধ্য হয়। মে দিবস মূলত এমনই প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি।
মে দিবসের পটভূমি
১ লা মে’র ঘটনাটি বিশেষ একদিনের কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সুদীর্ঘ শতাব্দী ধরে ঘটে আসা বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলনের পরিপূর্ণ বিকাশ। ১৮২৭ সালে পৃথিবীর প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন হিসাবে খ্যাত Mechanics Union of philadelphia ` ১০ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৮৩৪ সালে নিউ ইয়র্কের বেকারী শ্রমিকরা ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা শ্রম দেবার প্রতিবাদে ধর্মঘট করে। ১৮৩৭ সালে ১০ ঘণ্টার কর্ম দিবস একটি আন্দোলনে রূপ নেয়। তারপর ১৮৫৬ সালে অস্ট্রোলিয়ায় শ্রমিকরা ‘8 hours work, 8 hours recreation and 8 hours rest’ এই দাবীতে আন্দোলন শুরু করলে বিশ^ব্যাপী ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীটি সোচ্চার হয়ে উঠে।
১৮৭৭ সাল থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরী, ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা কর্মঘণ্টা এবং উন্নত কর্মপরিবেশের দাবীতে ধর্মঘট শুরু করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ মালিকদের পক্ষ নিয়ে এসব সংগ্রামে অংশগ্রহণ কারীদের উপর নিষ্ঠুর দমননীতি চালিয়ে যেতে থাকে। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০০ শ্রমিক দাবি আদায়ের সংগ্রামে প্রাণ দেয়। এরই এক পর্যায়ে ১৮৮৪ সালের ৭ ই অক্টোবর আমেরিকার “ফেডারেশন অব লেবার” তাদের জাতীয় সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘোষনা দেয় যে, দাবী মানা না হলে ১৮৮৬ সালের ১লা মে সারাদেশে বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ ধর্মঘট পালন করা হবে। মালিক পক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্রমিক আন্দোলন নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ভয়াবহ নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রশাসন কঠোর মনোভাব নিয়ে শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতারসহ নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে। এসব নির্যাতনের মুখেও ১৮৮৬ সালের ১ লা মে ৮ ঘণ্টার কর্মঘণ্টার দাবীতে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে এগার হাজারেরও বেশী শিল্প কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘটে অংশ নেয়। ৩ রা মে শিকাগোর মেক’ কমিক রিপার কারখানার ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপরে পুলিশ গুলিবর্ষন করলে ৬ জন শ্রমিক নিহত হয়। অনেকে আহত হয় এর প্রতিবাদে ৪ ঠা মে শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে আহবান করা হয় এক বিশাল শ্রমিক সমাবেশ। এ সমাবেশেও পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে শ্রমিকরা রুখে দাড়ায়। শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে ৪ জন শ্রমিক ও ৭ জন পুলিশ নিহত হয়। আহত ও গ্রেফতার হয় অনেকে। নেতৃবৃন্দের মধ্যে গ্রেফতার হন অগাষ্ট স্পাইজ, স্যুামুয়েল ফিলডেন, মাইকেল স্কোয়ার, জর্জ এঙ্গেল, এ্যডলফ ফিশার, লুই লীংগ, অস্কার নিভে ও এ্যালবার্ট পারসনস। ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর স্পাইজ, ফিশার, এঙ্গেল ও পারসনস এর ফাঁসি হয়। লীংগ কারাগারেই মৃত্যু বরণ করেন। অনেকের যাবজ্জীবন কারাবাস হয়। ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিয়ে, গুলিতে মৃত্যু বরণ করে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে তারা অমর হয়ে রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে হে মার্কেটে ঘটনার পরই দুনিয়ার শ্রমিক আন্দোলনে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। মেনে নিতে হয় শ্রমিকদের মূল দাবী ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবীও।
এ ঘটনার প্রায় ৩ বছর পর ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশ। এ সমাবেশে প্রতিবছর মে মাসের প্রথম দিনকে বিশ্বব্যাপী “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাইড পার্কে সমবেত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সভায় মে দিবস পালিত হয়। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত হয় মে দিবসের মিছিল। পরে রশিয়া, চীন ও জার্মানীতে মে দিবস পালিত হতে থাকে। ভারত উপমহাদেশে এর সূচনা হয় ১৯২৩ সালে মাদ্রাজে।
ট্রেড ইউনিয়ন
একদিকে দুনিয়াব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম যেমন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তেমনি শিল্প বিপ্লব তথা সভ্যতার বিকাশে শ্রমিক শ্রেণীর অবদান ও গুরুত্ব ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। শ্রমিক সমস্যা, তাদের অধিকার তথা শিল্প-শ্রমিক নিয়ে দেশেদেশে শুরু হয় মূল্যায়ন, নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়ন। রাষ্ট্র, সরকার তথা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক গুরুত্ব পেতে থাকে শিল্প শ্রমিক প্রসঙ্গ। পর্যায়ক্রমে শ্রম ও শ্রমিক বিষয়ে তৈরী হয় শ্রম আইন। গড়ে উঠে শ্রম আদালত, শ্রমদপ্তর, শ্রম মন্ত্রানালয়। প্রতিষ্ঠা লাভ করে International labour organization (ILO) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। তৈরী হয় শ্রমিকদের অধিকার সম্বলিত আই এল ও কনভেনশন। যা দেশে দেশে পর্যায়ক্রমে গৃহীত ও প্রতিপালিত হতে থাকে। বদলে যায় ‘শ্রমিক’ শব্দটির আইনগত অর্থ ও ব্যাখ্যা। শাব্দিক অর্থে যদিও ‘শ্রমিক’ অর্থ – ‘যে শ্রম দেয় বা কায়িক পরিশ্রম করে যে’। কিন্তু আইনগতভাবে শ্রমিক শব্দের অর্থ দাড়ায় ‘অর্থের বিনিময়ে কায়িক শ্রম বিক্রয় করে যে’। শিল্প আইনে শ্রমিক হতে গেলে প্রয়োজন ৪ টি বৈশিষ্টের (ক) জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ (খ) অন্যের দ্বারা নিয়োজিত অন্যের কাজ (গ) অন্য কাউকে নিজের কাজের জন্য পারিশ্রমিক দিয়ে নিয়োজিত করতে পারে না (ঘ) নিজের জন্য কাজ করেনা। (Self employed নয়)।
সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের দ্বান্দ্বিক যাত্রা পথে এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ^ পরিস্থিতিতে মুক্ত বাজার অর্থনীতির দিকে ধাবিত হতে থাকে ‘শিল্প ও শ্রমিক’। কর্মস্থলে শ্রমিকের সুরক্ষা এবং দরকষাকষির প্রয়োজনে সময়ের দাবী অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন আইন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। একদিকে ট্রেড ইউনিয়নকে সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যায় School of communism হিসাবে গ্রহণ করে ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদকে বিলুপ্ত সাধন করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে শ্রমিকরাজ তথা শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারনা দেয়া হতে থাকে। অন্যদিকে মুক্ত বিশ্বে (Free world) ট্রেড ইউনিয়নের সংজ্ঞা হলো- ‘শ্রমিকদের, শ্রমিকদের দ্বারা, শ্রমিকদের জন্য, স্বেচ্ছাসৃষ্ট এক ধারাবাহিক স্থায়ী ও গণতান্ত্রিক সংগঠন’। এ ব্যাখ্যা মোতাবেক ট্রেড ইউনিয়নের উদেশ্যে হলো কর্মস্থলে নিজেদের রক্ষা করা, যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে নিজেদের কাজের শর্তাবলীর উন্নতি সাধন করা, নিজের জীবনের মানকে উন্নততর করে তোলা, স্বাভাবিক ও মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষা করা, সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে শ্রমিকদের মতামত প্রকাশের উদেশ্যে উপযুক্ত উপায় নির্ধারণ করা।
ট্রেড ইউনিয়নের সংজ্ঞায় ইংরেজী অভিধানে বলা হয়েছে’ – Trade union means union among the men of the same trade to maintain their rights. অর্থাৎ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত একই পেশার লোকদের সংঘ।
আমেরিকার শিকাগো থেকে প্রকাশিত – The world book encyclopedia পুস্তকে বলা হয়েছে – Labour movement is a term that refers to the efforts of workers as a group to improve their economic position……..
Political parties and other groups has also played a part in the Labour movement (The world book encyclopedia Chicago. usa. Page-5)| বাংলাদেশে Industrial relation ordinance – 1969 (IRO – 1969) এ ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে – Trade union means any combination of workmen or employers formed primarily for the purpose of regulating the relationship between workmen or workmen and employers or employers, or for imposing restrictive on the conduct of any trade of business and includes a federation of two or more trade unions. ট্রেড ইউনিয়ন বলতে প্রধানত শ্রমিকের সাথে মালিকের অথবা শ্রমিকের সাথে শ্রমিকের অথবা মালিকের সাথে মালিকের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রন করার উদেশ্যে অথবা কোন বাণিজ্য কিংবা ব্যবসা পরিচালনার উপর নিয়ন্ত্রন মূলক শর্ত আরোপের জন্য গঠিত শ্রমিকের অথবা মালিকের কোন সংঘকে বুঝাবে এবং দুই বা ততোধিক ট্রেড ইউনিয়নের কোন কোন ফেডারেশন এ কথার অন্তর্ভুক্ত হবে। উক্ত সংজ্ঞা থেকে বুঝা যায় ট্রেড ইউনিয়নের কাজ ৩ টি (১) একই পেশার লোকের অধিকার আদায় (২) সম্পর্ক বজায় রাখা (৩) আচার-আচরণের উপর শর্তরোপ করা, আচরণবিধি আরোপ করা। উক্ত সংজ্ঞায় এটাও জানা যায় যে, শ্রমিক কর্মচারীরাও ইউনিয়ন বা সংঘ, সমিতি বা দল গড়তে পারে। আবার মালিক কর্তৃপক্ষ ও সংঘ, সমিতি বা দল করতে পারে।
ট্রেড ইউনিয়নের ইতিহাস থেকে জানা যায় পৃথিবীর প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন ‘Mechanics union of Philadelphia’ ১৮২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৩-৩৪ সালে গঠিত হয় ‘গ্রান্ড ন্যাশনাল কনসলিটেটেড ট্রেড ইউনিয়ন’। উপমহাদেশে ১৮৫০ সাল থেকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূচনা হয়। সর্বপ্রথম ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয় ১৮৯০ সালে। নাম ‘‘Bombay mill hands association’. নেতা ছিলেন Mr. NN lokhen. ১৯২১ সালের ১ লা মার্চ ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টে ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত রেজুলেশন গৃহীত হয়। ১৯২৫ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তা পেশ হয়। ১৯২৬ সালে উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ট্রেড ইউনিয়ন আইন পাস হয়। ১৯২৭ সালে ১ লা জুন থেকে তা কার্যকর হয়।
প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর ১৯১৯ সালের ১১ এপ্রিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা International labour organization (ILO). গঠিত হয় – ভার্সাই চুক্তির ফলে লীগ অব নেশনস এর অঙ্গ সংগঠন হিসাবে। এটা ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আই এল ও সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৩ সালের ২৫ ই জুন আই এল ও ঢাকা অফিসের কার্যক্রম শুরু করে। শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় আই এল ও এর মোট ১৮৯ টি কনভেনশন রয়েছে যার মধ্যে থেকে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৩৫ টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে এবং দেশে কার্যকর আছে।
বাংলাদেশে ১৯৬৫ সালে শ্রমিক নিয়োগ স্থায়ী আদেশ (Employment of labour act standing order 1965) আইন হয়। ১৯৬৯ সালে শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ (Industrial relation ordinance 1969) হয়। যার ভিত্তিতে ট্টেড ইউনিয়ন কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। মালিক সমিতি প্রায় ১ হাজার এবং জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন সংখ্যা ৩৭ টি। অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন সংখ্যা প্রায় ২ হাজার যার সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ১২ লাখ।
বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা ও উন্নয়ন ধারনাও যুক্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে আইন অনুযায়ী CBA (Collective bargaining agent) সম্মিলিত দরকষাকষি এজেন্ট শ্রমিক প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। শ্রমিক, মালিক ও সরকার TCC (Tripartite consultative committee) বা ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদও কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
কিন্তু বেদনার বিষয় হলো – এত পরিকল্পনা, আইনও উদ্যোগের পরও শ্রমিক সমাজ আজও উপেক্ষিত, অধিকার বঞ্চিত। আইন আছে কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সমিতি বা সংঘ করার যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তারই অধীনে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার স্বীকৃত। জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার দলিলে ২৩ (৪) অনুচ্ছেদে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ এতসব অধিকার ও আইনের সত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের আজও বদল হয়নি। বরং একশ্রেণীর সুবিধাভোগী শক্তি শ্রমিকদের সংবেদনশীল স্বার্থগুলোকে মাধ্যম হিসাবে কাজে লাগিয়ে মুখরোচক স্লোগান ব্যবহার করে শ্রমিক সমাজকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী, সমাজতন্ত্রী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাধী নেতৃত্ব নিজেদের হীন স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহার করে শুধু তাদেরই কপাল বদলিয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের কপালে দু:খ কষ্টের আগুন আজও দাউ দাউ করে জ্বলছে।
মহানবীর (সা:) এর আদর্শই শ্রমিকের প্রকৃত মুক্তির পথ
একদিকে শ্রমিক আন্দোলনের নামে যেমন শুধু অধিকারের ফাঁকা আওয়াজ তুলে প্রতারিত করা হয়েছে নিরীহ দু:খী শ্রমিক সমাজকে। শ্রমিক সমাজের কর্তব্য, দক্ষতা, নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করে কখনো কখনো উৎপাদনশীলতা, অর্থনীতি ও সমাজের শান্তি স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মালিক-শ্রমিক সু-সম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমঝোতা ও দেশপ্রেমকে হীনস্বার্থে ধ্বংস করা হয়েছে। অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য ও দায়িত্বের অনুভূতি তথা মূল্যবোধ জাগ্রত করাও যে নেতৃত্বের কাজ, সেসব বেশীর ভাগ সময়ই তারা বেমালুম ভুলে থেকেছেন। বস্তুত ট্রেড ইউনিয়ন, প্রচলিত শ্রমনীতি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ইত্যাদি সম্পর্কেও বলতে গেলে শ্রমিক সমাজ অন্ধকারেই রয়ে গেছে। এমনকি মানবতার শ্রেষ্ট আদর্শ বিশ্ব নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা:) প্রদর্শিত ইসলামী শ্রমনীতির শ্বাস্বত বিধান সম্পর্কেও শ্রমিক সমাজকে জানতে দেওয়া হয়নি। তার কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ – প্রচেষ্টা আজও দৃশ্যমান নয়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
শ্রমিকের জন্য বহুবিধ মৌলিক অধিকার রয়েছে। যেমন: চাকুরীর, নিয়োগ ও শর্তাবলী, শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান, মালিক-শ্রমিক সু-সম্পর্ক, কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরী, চাকুরী ও জীবনের নিরাপত্তা-নিশ্চয়তা, সাধ্যের অতিরিক্ত শ্রম না দেওয়া, পেশাগত প্রশিক্ষন, কাজ শেষে মজুরী, মুনাফায় শ্রমিকের অধিকার, শ্রমিকের কষ্ট লাঘব, নারী-পুরুষ শ্রমিকের সমতা বিধান চাকরির সকল ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তি, পোষ্যদের ভরণ পোষন, চাকুরীতে পদোন্নতি, বেতন পরিশোধের নীতিমালা, ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ, ছুটি ও বিশ্রামের বিধান, জুলুমের প্রতিবাদ, সংগঠন করার অধিকার, যৌথ দরকষাকষির বিধান, অবসরকালীন ভাতা, সন্তানদের শিক্ষার অধিকার, নিরাপদ বাসস্থান, চিকিৎসার অধিকার, অমুসলিম শ্রমিকের অধিকার, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও প্রসূতিকালীন ছুটি ও সুবিধা, শিশু শ্রম, শিশু যত্নাগার, রাষ্ট্রীয়করণ ও বিরাষ্ট্রীকরণ নীতি, অপরাধ ও দন্ডবিধি, শ্রমবিরোধ নিষ্পত্তি, দুর্ঘটনা কবলিত শ্রমিকের সুযোগ সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ এবং ওয়েলফেয়ার ইত্যাদি।
এসব অধিকার ও আইনের ইনসাফ ভিত্তিক কোন বাস্তবায়ন মানবরচিত মতবাদ বা শ্রমনীতির মাধ্যমে কি সম্ভব? পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের ব্যর্থতার পটভূমিতে নিপিড়িত, বঞ্চিত, অনাহারি ও মজলুম শ্রমজীবী মানুষের আজ ফরিয়াদ – তারা প্রকৃত মুক্তি চায়। প্রতারক ও স্বার্থন্বেষী চরিত্রহীন নেতৃত্বের বেড়াজাল ছিন্ন করে তারা বেরিয়ে আসতে উদগ্রীব। নীতি নৈতিকতার মানে যারা উন্নত এমন নেতৃত্বের আজ তাই শ্রমিক ময়দানে অনিবার্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান কোন জোড়াতালি বা মানবরচিত বিধানের মাধ্যমে যে সম্ভব নয় তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। দেশ পরিচালকরা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি মেধা, ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার শিক্ষাকে যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু তারা মহান আল্লাহ্র দেওয়া বিধান ও বিশ্ব নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা:) এর আদর্শের কোন প্রয়োজনই মনে করেন না। অথচ গোটা প্রাকৃতিক জগত তার বিধান মেনে চলছে বিধায় সেখানে কোন বিশৃংখলা নেই। সেজন্য মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন কুরআন মজিদ ও রসুল (সা:) এর মাধ্যমে মানবজাতির সুখ-শান্তির যে বিধান দিয়েছেন তা পালন করা ছাড়া জীবনের কোন সমস্যারই স্থায়ী ও সন্তোষজনক সমাধান হতে পারে না।
সবচেয়ে অসভ্য, বর্বর, বিশৃংখল ও অশিক্ষিত মানব সমাজে কোন যাদুবলে রসুলে করীম (সা:) মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে এক বিস্ময়কর বিপ্লব ঘটালেন! এর ফলে সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি চমৎকার রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো? মোহাম্মদ (সা:) এর উন্নত মহান চরিত্রের পরশমণির সংস্পর্শে অসভ্য মানুষগুলো সভ্যতার শিক্ষকে পরিণত হলেন। এ নতুন সভ্যতার উত্থানকে ঠেকাতে ও ধ্বংস করতে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য চেষ্টা করে নিজেরাই পরাজিত ও পদানত হতে বাধ্য হয়। ইতিহাসের ঐ অলৌকিক ঘটনার পেছনে কোন যাদুবিদ্যা ছিল না। কুরআনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতি গড়ার বিধান মানবজাতির স্রষ্টা আল্লাহই পাঠালেন। মানবদরদী ও মানবজাতির পরম বন্ধু হিসাবে মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা:) ঐ বিধানকে প্রয়োগ করেই এ অভাবনীয় বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হলেন। এটা কোন উদ্ভট দাবী নয়; প্রমানিত বাস্তব ঐতিহাসিক সত্য। অনুরূপভাবে শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানও সেখানেই রয়েছে।
আল্লাহর হাবীব প্রিয় নবী (সা:) শ্রমজীবী মানুষকে অনন্য মর্যাদায় সম্মানীত করেছেন – যা অন্য কোন আদর্শের নেতৃত্বের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার কয়েকটি সংক্ষিপ্ত উদহারণ:
১. শ্রমিক যায়েদ (রা:) কে ফুফাতো বোন জয়নবের সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন।
২. হযরত যায়েদ (রা:) কে মুতার যুদ্ধে প্রথম সেনাপতি পদে নিয়োগ করেছিলেন।
৩. শ্রমিক পুত্র উসামা বিন যায়েদ (রা:) কে প্রধান সেনাপতি বানিয়ে তার হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলেন।
৪. শ্রমিক হযরত বেলাল (রা:) কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বানিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।
৫. মক্কা বিজয়ের দিন কাবাঘরে প্রবেশের সময় শ্রমিক হযরত বেলাল (রা:) ও শ্রমিক হযরত খাব্বাব (রা:) কে সাথে রেখেছিলেন।
৬. কোদাল চালাতে চালাতে একজন সাহাবীর হাতে কালো দাগ পড়ে গিয়েছিল। রসুল (সা:) তার হাত দেখে বললেন, ‘তোমার হাতের মধ্যে কি কিছু লিখে রেখেছো? সাহাবী বললেন, হে আল্লাহার রাসূল এগুলো কালো দাগ ছাড়া কিছু নয়। আমি আমার পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষনের জন্য পাথুরে জমিতে কোদাল চালাই, তাই এ দাগগুলো পড়েছে। রাসূল (সাঃ) এ কথা শুনে সাহাবীর হাতের মধ্যে চুম্বন খেলেন। (উসুদুল গাবা)
৭. রাসূল (সা:) এর খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) দীর্ঘকাল এক সাথে অবস্থান করলেও কখনো রাসূল (সাঃ) ধমক দেননি এবং কোন কৈফিয়তও তলব করেননি।
মানবতার দরদী বন্ধু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য এক ঐতিহাসিক ভাষণে যে অনুপম শ্রমনীতি দিয়ে গেছেন তার কিয়দংশ নিম্নরূপ:
‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি যে, গোলামদের সাথে ভালো আচরণ করবে এবং তাদের কোন কষ্ট দিবে না। তোমরা কি জান না যে, তাদের একটা অন্তর আছে, যা কষ্ট পেলে ব্যথা পায় এবং আরাম পেলে আনন্দিত হয়। তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা তাদেরকে হীন মনে কর এবং তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করনা! এটা কি জাহিলিয়াতের যুগের মানসিকতা নয়। অবশ্যই এটা জুলুম এবং বে-ইনসাফী।
আমার সেই যুগের কথা মনে আছে, যখন রাষ্ট্রপতি, সমাজপতি ও দলপতিরা নিজেদেরকে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানীত মনে করতো এবং নিজেদেরকে নির্ভুল ও নির্দোষ বলে প্রচার করতো। তাদের নিকট অধীনস্ত খাদেমের জীবনের উদ্দেশে ছিল তারা মালিকের খেদমত করবে, তাদের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে থাকবে। তাদের সামনে বসাও ছিল অন্যায়, তাদের সামনে কথা বলাও ছিল মহাপাপ এবং তাদের কোন অপকর্মের প্রতিবাদ করা ছিল মৃত্যুদ-তুল্য। কিন্তু ইসলাম এসে তাদের এসব অমানবিক আচরণ ও গর্ব অহংকার পদদলিত করে দিলো।
ইসলামী আদর্শের কাছে মনিব-গোলাম, বড়-ছোট, আমীর-ফকীর সবাই সমান। মানুষের মধ্যে শুধুই তাকওয়া এবং সৎকাজের মাধ্যমেই পার্থক্য হতে পারে। এটা যখন প্রকৃত ব্যাপার, তবে তোমরা কেন তোমাদের অধীনস্থদের হীন মনে কর। আমি লক্ষ্য করছি যে, যখন কোন খাদেম তার মালিকের সাথে কথা বলতে চায়, তখন সে রাগের বশে চেহারাকে রক্তিম করে নিজেকে পেশ করে এবং খাদেমের পক্ষ থেকে সামান্যতম ভুলও বরদাস্ত করে না। এটা জাহিলিয়াতের আচরণ ছাড়া আর কি হতে পারে? মালিকের গোলাম অনেক ভাল এবং মহান আল্লাহর কাছে তার আমল পছন্দনীয়। আমি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তোমাদের বলছি যে, তোমরা তাদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে তোমরা তাদের থেকে এতটুকু কাজ নিবে যা তাদের জন্য সহজ। তোমরা তাদেরকে তাই খেতে দিবে, যা তোমরা নিজেরা খাও। তোমরা তাদেরকে তাই পরতে দিবে, যা তোমরা নিজেরা পরিধান কর। তোমরা তাদের সাথে সেরকম আচরণ করবে, যে ধরনের আচরন তোমরা তোমাদের প্রিয়জনদের সাথে করে থাক। তোমরা তাদের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা তোমরা নিজেদের জন্য পছন্দ করে থাক। যখন তোমরা তাদেরকে সফরে নিয়ে যাও তাদের আরাম আয়েশের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। যদি তোমাদের কাছে কোন বাহন থাকে, কিছু সময় তোমরা আরোহণ কর আবার কিছু সময় তাদেরকে বাহনে আরাম করার সুযোগ করে দাও।
আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, যখন কোন খাদেম তোমাদের নিকট খানা নিয়ে আসে তোমরা তখন তাদেরকে তোমাদের সাথে বসিয়ে খাওয়াবে। যদি খাবার পর্যাপ্ত না হয়, অন্তত কিছু না কিছু তাকে দিয়ে দাও। গোলামেরা যদি কোন অন্যায় করে তাহলে প্রতিদিন সত্তরবার তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। এজন্য যে, তোমরা যার গোলাম তিনি হাজারও অন্যায় ক্ষমা করে দিচ্ছেন। স্মরণ করো যে ব্যক্তি অধীনস্তদের উপরে এমন অভিযোগ উত্থাপন করবে মূলত সে তা করেনি। তাহলে কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তিকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। তোমাদেরকে আমি বার বার বলছি যে, অধীনস্থরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাদেরকে এমন কঠিন কাজ দিওনা যা তাদের শক্তির চেয়েও বেশী। (খুতবাতে নবী করিম (সাঃ)।
মেহনতি মানুষের জন্য প্রিয় নবীর এই ভাষণে ইসলামী শ্রমনীতির মূলনীতি বিধৃত হয়েছে সন্দেহ নেই। মহান আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, মানবজীবনের যে কোন সমস্যার সমাধানে সঠিক পথ নির্দেশনা কি? আল কুরআনের ঘোষনা: ‘তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তা আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশ মোতাবেক মীমাংসা করে লও। (সূরা নিসা -৫৯)।
কুরআন ও হাদীস গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বের করা সম্ভব ইসলামী শ্রমনীতির বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক ও বিভাগ। নিম্নোক্ত হাদীসটি ইসলামী শ্রমনীতির বিধিবিধান এর মূল উৎস হতে পারে:
‘হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাঃ) যখন তাকে ইয়ামেনে গভর্নর এর দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করছিলেন, তখন নবী করিম (সাঃ) তাকে প্রশ্ন করলেন, যখন তোমার সামনে কোন সমস্যা দেখা দিবে তখন তুমি কিভাবে তার সমাধান করবে? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কিতাব অনুসারে সকল সমস্যা সমাধান করতে চেষ্টা করবো। হুজুর (সাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, যদি আল্লাহ্র কিতাবের মধ্যে কোন বিষয়ের ফয়সালা খুঁজে না পাও? তিনি বললেন, রসুলের সুন্নত অনুসারে ফয়সালা করবো। হুজুর (সা:) তাকে আবারো প্রশ্ন করলেন, যদি তুমি রাসূলের (সাঃ) সুন্নতের মধ্যেও কোন বিষয়ের সমাধান খুঁজে না পাও? তিনি বললেন যে, আমি নিজেই ইজতিহাদ করে সে কাজের ফয়সালা করার চেষ্টা করবো। এ ব্যাপারে কোন প্রকার অলসতা করবো না। নবী করিম (সা:) তার জবাব শুনে তার সীনার উপরে হাত রেখে বললেন যে, আল্লাহ তার রসুলের প্রতিনিধিকে রাসূলের মনঃপুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তৌফিক দিয়েছেন’। (তিরমিযী, আবু দাউদ)।
উল্লিখিত হাদীসটি যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। কুরআন, হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের মতামত ও কার্যাবলী এবং ইমামদের অভিমত সমূহের আলোকে গবেষনা করে ইসলামী শ্রম আইন প্রণয়ন করে আধুনিক শিল্পায়িত বিশ্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা মোটেই অসম্ভব বা কষ্টকর নয়। তবে আমরা যারা ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ইসলামী আন্দোলন করছি এবং ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি তাদেরকে একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটি ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রাম এক ও অভিন্ন। ইসলামী শ্রমনীতি গোটা ইসলামী ব্যবস্থারই একটি অংশ। ইসলামের অংশবিশেষ পৃথকভাবে কোথাও পুরোপুরি কায়েম করা যায়না, ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ব্যতীত। অর্থ্যাৎ ইসলামী পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা কায়েম হলেই কেবল ইসলামী শ্রমনীতিসহ সব দিক ও বিভাগ চালু হওয়া সম্ভব। তাই আমাদেরকে ইসলামী শ্রমনীতির সুফল জনগণের কাছে পৌছে দেবার প্রচেষ্টা জোরদার করার পাশাপাশি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেও একই সাথে এগিয়ে নিতে হবে।
শিকাগোর সংগ্রাম ১৮৮৬ সাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ১৩১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমরা কি পেয়েছি? আমরা ট্রেড ইউনিয়ন পেয়েছি। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা, আইন ও নেতৃত্ব তৈরী হয়েছে। অগনিত শ্রমজীবী মানুষ তাদের জীবনও বিলিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে দুঃখী বঞ্চিত, শ্রমজীবী মানুষের কতটা ভাগ্যের বদল হয়েছে? তাদের জীবনযন্ত্রণা কি থেমেছে? আজও বিশে^র প্রান্তে প্রান্তে অন্নহীনের কান্না, বস্ত্রহীনের মর্মব্যাথা আর নিরাশ্রয়ের আকুতি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত।
শ্রমজীবী মেহনতি জনতার তাই ইসলামের শ্বাস্বত, কালজয়ী ও অনুপম মুক্তির কল্যাণময় পথে ফিরে আসা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। মানুষের উপর মানুষের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে কেবল মহান সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তায়ালার সার্বভৌমত্বকে কবুল করে নেওয়ার মধ্যে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত মুক্তি ও কল্যাণ নিহিত।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন
ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে একটি কল্যাণময় ইসসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬৫ সালের ট্রেড ইউনিয়ন আইন এর আওতায় ১৯৬৮ সালের ২৩শে মে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল জাতীয় ফেডারেশন নম্বর ০৩। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ ও ১৯৭৭ সালের শিল্পসম্পর্ক বিধিমালার বিধান মোতাবেক বাংলাদেশ সরকারের Labour directorate এ ১৯৮০ সালের ১৫ই মে দ্বিতীয়বার নিবন্ধন লাভ করে। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর বাংলাদেশ জাতীয় ফেডারেশন (বা.জা.ফে) ০৮। বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ফেডারেশনটি আজ ৪৯ বছরের পুরাতন ইসলামী পতাকাবাহী একমাত্র শ্রমিক সংগঠন। জন্মলগ্ন থেকেই ট্টেড ইউনিয়ন সংগঠনের মাধ্যমে দক্ষতা,আন্তরিকতা, সততা ও যোগ্যতায় পেশা-শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলেন নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শত শত বেসিক ইউনিয়ন ও পেশাভিত্তিক ফেডারেশন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের অন্তর্ভূক্ত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে অব্যাহত গতিতে কাজ করে যাচ্ছে।
ফেডারেশনটি International Labour Organisation (ILO) এর অনুসমর্থিত কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ দ্বারা সমর্থিত। International Islamic Confederation of labour (IICL) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং আই আই সি এল-এর নির্বাচিত সহ-সভাপতি (Vice-president)। শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন (১৯৬৮-৭২) কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন মরহুম ব্যারিস্টার কুরবান আলী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ড. গোলাম সরওয়ার।
আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ১লা মে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির চেতনায় উদ্ভাসিত হোক। শিকাগোর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিকামী মজলুম মনবতার জন্য বিশ্বনবীর মহান আদর্শই হয়ে উঠুক বিশ্ব শান্তির শেষ ঠিকানা।